আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ফেসবুক, হোআটসাপ এ মেসেজের বন্যা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে একে অপরকে উইশ করেছে। আমিও করেছি। যদিও আমি কোনো বিশেষ দিনের সেলিব্রেশন এ বিশ্বাসী নই সে মাদার্স ডে হোক,ভ্যালেন্টাইনস ডে হোক কিংবা ওমেন্স ডে। আমার মনে হয় আলাদা করে একদিন মা, বাবা, বন্ধু কিংবা প্রেমিক কে বেশি ভালোবাসা যায়না। তবুও, বছরে একটা দিন আমরা বেছে নিতে শিখেছি একটু আলাদা করে, খুব যতনে, তাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কিংবা অনুভূতি বিশেষ ভাবে প্রকাশ করার জন্য। আমি তাতে কিছু ভুল বা বাড়াবাড়ি দেখতে পাইনা।
তবে আজ নারীদিবস উপলক্ষে মনে হলো যে কিছু কথা লিখি। বছরে একবার নারী দিবস আসলেও, আমাদের নারীদের কিছু চিন্তাভাবনা সারাবছর একটু মাথায় রাখা উচিত, এটা আমি মনে করি এবং এটা মানিও যে এই ভাবনাগুলো শুধু আমার না আমার মত অনেক এর ই। এই ভাবনাচিন্তা গুলো যদি সারাবছর আমরা নারীরা মাথায় নিয়ে চলতে পারি তাহলে হয়তো একটু একটু করে আমরা নিজেদের জন্য মজবুত জায়গা করে নিতে পারবো এই সমাজে।
আমার মতে, যেদিন কন্যা সন্তান এর জন্মের পর কোনো মায়ের বুক কাঁপবে না। যেদিন কন্যা সন্তান জন্মালে ঠাকুমা হাসি মুখে বলবে লক্ষ্মী এসেছে ঘরে। যেদিন পিসি ঠাকুমা মুখ বেঁকিয়ে বলবেনা, যে বংশে প্রদীপ দেখাবে কে?যেদিন কোনো মেয়ের বাবা কে শুনতে হবে না যে মেয়ে হয়েছে এখন থেকে একটু একটু করে সঞ্চয় করো , আজ নয় কাল, বিয়ে তো দিতেই হবে। যেদিন সমাজ কোনো মেয়ের বাবাকে কন্যাদায় গ্রস্থ পিতা বলে সম্বোধন করবেনা। যেদিন কোনো মা তার মেয়েকে বলবেনা, যে আস্তে কথা বল, মেয়েদের জোর গলায় কথা বলতে নেই। যেদিন মা তার মেয়েকে মানিয়ে নিতে শেখো, এটা শেখাবে না। যেদিন পাশের বাড়ির কাকিমা উচ্ধমধ্যমিক এ ভালো রেজাল্ট করা মেয়েটাকে বলবেনা, যতই পড়াশুনা করো আর যাই করো, খুন্তি ই সেই ধরতে হবে। যেদিন কোনো মা, তার গ্র্যাজয়েশন পাশ করা মেয়েকে পাত্রপক্ষ এর সামনে মাথানিচু করে ইন্টারভিউ তে না বসতে বলে, চাকরী র ইন্টারভিউ তে বসতে বলবে। যেদিন পাশের ফ্ল্যাট এর জেঠিমা পর্দা সরিয়ে কোনো মেয়ের বাবা কে শোনাবেনা, যে দাদা মেয়ের তো বিয়ের বয়স হলো আর কতদিন? যেদিন কোনো মেয়েকে পাত্রপক্ষ এর তরফ এর পিসিমা জিজ্ঞেস করবেনা তুমি রাঁধতে পারো তো? যেদিন বিয়ের রাতে মেয়ের বাবা বরকত্তার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াবেনা। যেদিন থেকে কোনো শাশুড়ি তার বৌমা র চাকরী করা নিয়ে আপত্তি জানাবেনা। যেদিন রাস্তাঘাটে মেয়েদের কে আপত্তিজনক মন্তব্য শুনতে হবেনা, অটো, বাস কিংবা ট্রামে বারবার চুড়িদার এর ওড়না , শাড়ির আঁচল ঠিক আছে কিনা সেটা চেক করতে হবেনা। যেদিন কোনো মেয়ের শ্লীলতহানিতে অন্য কোনো মেয়ে বলে উঠবেনা ওরকম খোলামেলা পোশাক পরলে এরকমই তো হবে। যেদিন........ সেদিন হবে পূর্ণ অর্থে আমাদের , নারীদের দিন।
লড়াই টা কি সত্যিই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী দের সাথে পুরুষের? নারী দের সাথে নারী দের নয়তো? আজ গোটা নারী সমাজ নারী পুরুষ সমান সমান , মানে নারী পুরুষের সমানাধিকার এর দাবি তে গর্জে উঠছে। কিন্তু আমরা নারীরা কার কাছ থেকে সমানাধিকার দাবি করছি? সমাজের পুরুষ এর থেকে? সেই পুরুষ যাকে জন্ম দিয়েছে কোনো এক নারী, সেই পুরুষ যাকে জন্মের পর থেকে তুমি ই সর্বশক্তিমান শিখিয়েছে সেই এক নারী, সেই পূরুষ যাকে শেখানো হয়েছে রান্নাঘর এবং রান্না দুটো থেকে দূরে থাকো, ওটা মেয়েদের জায়গা আর সেটা শিখিয়েছে কোনো এক নারী ই, মাছ এর সব থেকে বড় পিস টা তোর বাবা র জন্যে, নিজের অজান্তেই কোনো এক নারী তার ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছেন যে, যা কিছু ভালো সব বাড়ির পুরুষ দের জন্য। লাল রঙের শাড়ী বড় প্রিয়, কিন্তু তোর বাবা পছন্দ করেনা আমি লাল শাড়ী পড়ি, তাই আমার জন্য হাল্কা কোনো রঙ এর শাড়ী কিনিস, এভাবে অজান্তেই শিখিয়ে দিয়েছেন নিজের পুত্র সন্তান কে যে পুরুষ এর পছন্দই শেষ কথা। পাশের বাড়ির যুবতি মেয়েটি যখন রোজ সকালে দৌড়ে অফিস বাস ধরতে যায়, তখন তার কাঁধের ল্যাপটপ ব্যাগ না, তার পরনের জিন্স চোখে পড়ে, কার? একজন নারীরই। তারপর মেয়েটির যোগ্যতা নয় তার পোশাক নিয়ে নিজের অজান্তেই স্বামী সন্তান এর সামনে আলোচনা জুড়ে দেন আবার সেই নারী ই। বৌমা বিয়ের পর বাড়ির সবাই কে কতটা সন্মান দিচ্ছে সেটা বিচার না করে, তার ঘোমটা, তার মাথার সিঁদুর এর দৈর্ঘ্য বিচার করতে বসেন সেই বাড়ির নারীরাই। তুই তো মেয়ে, পরের ঘরের লক্ষ্মী, কথা টা শিখিয়েছেন একজন নারী ই।
তাই বলছি, লড়াই টা নারী বনাম পুরুষ কোনোদিনও ছিল না ভবিষ্যতেও কোনোদিন হবে না, লড়াই টা বরাবর নারী বনাম নারীর ই ছিল। আমরা নারী রা যেদিন একে অপরকে সাহায্য করতে শিখবো, একে অপরের পাশে দাঁড়াতে শিখবো, একে অপরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবো। সব থেকে বড় কথা, যেদিন নিজে বাড়িতে নিজের জায়গা করে নিতে শিখবো, নিজের সন্মান রক্ষা করতে শিখবো, সমাজের চিরাচরিত বস্তা পচা নিয়ম কানুন এর বেড়াজাল থেকে নিজেদের কে বের করতে শিখবো, যেদিন স্বামী র পাশাপাশি নিজের জন্য ও ভালো বড় মাছ এর পিস রাখতে শিখবো, যেদিন শুধু মেয়েকে না ছেলেকে ও রান্না করতে শেখাবো, যেদিন কোনো মেয়ে র পরনের খোলামেলা পোশাক এর বদলে তার হাত এর ল্যাপটপ বা অফিস ব্যাগ হয়ে উঠবে আলোচনার বিষয়বিস্তু, যেদিন সিঁদুর এর দৈর্ঘ্য নয়, বৌমা র আচরণ কেমন, সেটা হবে চিন্তা র বিষয়, যেদিন কোনো মেয়েকে, ছেলে হবার ভূমিকা না নিভিয়ে, মেয়ের ভূমিকা তেই বাবা মা র খেয়াল নিতে বলা হবে, সেদিন আশপাশ তাকিয়ে দেখবেন যে আর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধর্নায় বসার প্রয়োজন নেই। সেদিন নারীরাই এগিয়ে এসে বলবেন আলাদা করে কিসের নারীদিবস? কারণ প্রতিদিন ই তো নারীদের, আমাদের, আমরা নারীরাই তো সমাজ তৈরী করি।
অনেক টা পথ আমরা নারীরা হেঁটে এসেছি আরও অনেক পথ চলা বাকি আমাদের। সেই চলার পথের লক্ষ শুধু নারীদিবস পালন করা না। লক্ষ্য প্রতিটা দিন প্রতিটা নারীর নিজেদের মত করে বাঁচার। :-)
সুস্মিতা সেন এর বলা কিছু লাইন উল্লেখ করে লেখা টা শেষ করতে চাই - "How do you change the world? Don't worry about it. The world will change on it's own. You change one life, you change one thought, you tell one Father that today truly you are a blessed man, because not only you have a girl, you have WOMB OF THE UNIVERSE", she will then nurture life beyond" - Susmita Sen.
Comments